মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান


বাঙালি জাতি ১৭৫৭ সালের পর থেকেই তার হারানো স্বাধীনতাকে ফিরিয়ে পাওয়ার জন্য সন্তর্পণে যুদ্ধ করছে, কখনও প্রত্যক্ষ এবং কখনও পরোক্ষভাবে। অবশেষে সফল হয়েছে ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান নামক দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্মের মাধ্যমে। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর নতুন করে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর নানা দুর্নীতি, শাসন-শোষণ এবং নির্যাতনের কবলে পড়ে বাঙালিরা। ফলে শুরু থেকেই শুরু হয় প্রতিবাদ-সংগ্রাম। এই প্রতিবাদ করতে গিয়ে বাঙালি অনেক ছাত্র নেতা মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পাক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে জেলজুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছে। অবশেষে চূড়ান্তভাবে আমরা জয়ী হয়েছি ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। এই মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অবদান রেখেছেন। কখনও তারা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাযতœ করেছেন, আবার কখনও যুদ্ধ করেছেন অস্ত্র হাতে তুলে। নিয়েছেন পুরুষের পাশাপাশি সশস্ত্র প্রশিক্ষণ।
১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম থেকেই দেশের প্রতিটি অঞ্চলে যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় তাতে নারীদের বিশেষ করে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যে সকল নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিল গোবরা ও লেম্বুছড়া ক্যাম্প। তাছাড়া উইমেন্স কো-অর্ডিনেটিং কাউন্সিলের প্রশিক্ষণ, মেজর জিয়াউদ্দীন বাহিনীর প্রশিক্ষণ, মেজর জলিলের নারী বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও সিরাজ সিকদার বাহিনীর ক্যাম্প প্রশিক্ষণও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের যে সকল নারী সাহসিকতা নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ডা. সেতারা বেগম ও তারা ভানু বিবিকে (তারামন বিবি) বাংলাদেশ সরকার বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করে। তাছাড়াও সম্মুখ যুদ্ধে যে সকল নারীর কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের কথা জানা যায়, তাঁদের মধ্যে ক্যাম্প কর্মী বেনিলাল দাস গুপ্ত, শোভারানি মন্ডল, কাঁকন বিবি (খাসিয়া গোষ্ঠীর সদস্য), শিরিন বানু, বীথিকা বিশ্বাস, মিনারা বেগম ঝুনু, গীতশ্রী চৌধুরী, আলেয়া বেগম, ফেরদৌস আরা বেগম, আশালতা বৈদ্য, রওশন আরা বেগম, জিন্নাত আরা, করুণা বেগম, মেহেরুন্নেসা মিরা প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুক্তিয্দ্ধুকালে নারী মুক্তিযোদ্ধাগণ বিশেষভাবে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে অস্ত্র সংগ্রহ ও সরবরাহ ও তথ্য আদান প্রদান করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও সরবরাহ করতে গিয়ে অনেক নারী পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বেগম মুসতারী শফী, শ্রীমতি মিনা বিশ্বাস, জাহানারা ইমাম, বেগম সুফিয়া কামালের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তাছাড়া, গ্রামবাংলার মায়েরা নিজের ছেলেদের যুদ্ধে যেতে উদ্দীপনা জুগিয়েছেন, আগ্রহ দেখিয়েছেন, খাদ্য দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং স্থানীয় পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকার বাহিনীর খবর সংগ্রহ করে দিয়েছেন। কোনো, কোনো রণাঙ্গনে নারীরা হাতবোমা ও এসিড বালব্ব তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে মাঝে শত্রু অবস্থানের ভূমি বিন্যাস ও তাদের অবস্থান জানার জন্য নারী সদস্যদের সাহায্য নিতেন। ভিখারী, বিক্রেতা নানারকম সাজে নারীরা শত্রুর অবস্থানের কাছে গিয়ে তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের অবগত করতেন। এ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধকালে নারী মুক্তিযোদ্ধাগণ সংগঠন ও পরামর্শক, সাংস্কৃতিক প্রেরণাদাত্রী, কূটনৈতিক চরিত্র এবং প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবদান রেখেছেন।
এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধিতে তাদের অনুপ্রাণিত করতে ১৯৭১ সালের সাংস্কৃতিক দলগুলোর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। এই সকল দল উপ-দলের সদস্যরা কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থসংগ্রহ করেছেন। আবার অনেক দল মুক্তিযোদ্ধা অধিকৃত মুক্তাঞ্চল ভ্রমণ করে তাঁদের মনোবল বৃদ্ধি করেছেন। সাংস্কৃতিক প্রণোদনায় সর্ববৃহৎ ক্ষেত্রছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং এতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী সদস্য যুক্ত ছিলেন। তাঁদের অংশ গ্রহণে সেরা অনুষ্ঠাগুলি ছিল রণাঙ্গনে বাংলার নারী, মুক্তি সংগ্রামে মায়ের ভূমিকা শীর্ষক কথিকা, দেশাত্মবোধক গানে নারীর কণ্ঠ দেওয়াসহ প্রভৃতি। মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা নামে একটি সংস্থা ছিল, যার সদস্যরা বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলগুলো ঘুরে বেড়িয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে। এ সংস্থার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্য ছিলেন নারী। এ গ্রুপটির কর্মকা- নিয়ে পরবর্তীকালে মুক্তির গান চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে যুদ্ধাহত সৈনিকদের সহায়তা করতে নারীরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে মুজিবনগর সরকার একটি নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে। প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাচে ৩২ জন বাঙালি নারী এখান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং তাঁদেরকে বিভিন্ন হাসপাতাল ও যুদ্ধ ক্ষেত্রে সেবা প্রদানের জন্য পাঠানো হয়। এছাড়াও অনেক শিক্ষিত ছাত্র-ছাত্রী স্বপ্রণোদিত হয়ে অল্প কিছুদিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে বিভিন্ন শিবিরে গমন করেন।
২নং সেক্টরে বাংলাদেশ সরকারের ১টি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ হাসপাতালে বহু নারী সেবিকা দিনরাত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদান করেন। সেবা কর্মে দলবদ্ধভাবে নিয়োজিত হতে আগরতলা আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছা সেবিকা বাহিনী পূর্বাঞ্চল শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়াও নারীরা বিভিন্ন হাসপাতালে ও শরণার্থী শিবিরে সেবা প্রদান করতেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে এভাবেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলার নারী সমাজ তাদের সর্বংসহা চরিত্র থেকে বেরিয়ে  এসে পাকিস্তান সেনাবহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন। আর এভাবেই বাংলার বীর নারীদের সাহসী পদক্ষেপ, সেবা ও সহায়তা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে রেখেছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শুধু মুক্তিযুদ্ধে নয়, দেশ গঠনসহ প্রত্যেকটি কাজে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি অবদান রেখে কাজকে আরো বেশি ত্বরান্বিত করেছেন। যেখানে পুরুষের অবদান রয়েছে সেখানে নারীরও অবদান রয়েছে। নারীর এই স্বতঃস্ফূর্ত অবদানকে আমরা কোনো ক্রমেই অস্বীকার করতে পারবো না। তাই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেনÑ
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণ কর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, আর অর্ধেক নর।”
 লেখক :মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন 
সিনিয়র সহকারী শিক্ষক, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কুমিল্লা সেনানিবাস

Popular posts from this blog

অ্যাডভোকেট হতে হলে বা আইন পেশায় ঢুকতে হলে

All Education Board PSC Result 2017 Published

প্রথম শ্রেণি হতে একাদশ-দাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত বই পিডিএফ ডাউনলোড Class One to eleventh-twelfth Class all books PDF download